নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
প্রতি কেজি লালশাকে ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা থাকার কথা ১৯০ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু পরীক্ষায় মিলেছে ৭০৪ দশমিক ৩২ মাইক্রোগ্রাম। শুধু লালশাকেই নয়, বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া প্রায় প্রতিটি সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গেছে। রেহাই পায়নি ফলও। কেবল যে ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে এসব শাকসবজি ও ফলে, তা কিন্তু নয়। ক্রোমিয়াম, লেড বা সিসার মতো ক্ষতিকর পদার্থও পাওয়া গেছে এসবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দুটি গবেষণায় এ তথ্য জানা গেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে গতকাল সোমবার এক সেমিনারে গবেষণা প্রতিবেদন দুটি উপস্থাপন করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশক মিশ্রিত এবং ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সিসাসহ মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী ধাতু রয়েছে এমন শাকসবজি ও ফল দীর্ঘদিন খাওয়া হলে কিডনি জটিলতাসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি ক্যানসারও হতে পারে।
গবেষণা দুটির মধ্যে শাকসবজিতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি এবং এর মাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম ও ড. মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া আর ফলমূলে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন প্রধান।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ড. মোহাম্মদ সোয়েব। আলোচক ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরিচালক ড. শামশাদ বেগম কোরাইসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুন। সভাপতিত্ব করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মোহাম্মদ মোস্তফা।
শাকসবজিতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি নিরূপণের অংশ হিসেবে গবেষক দল ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ছয়টি জেলা থেকে আলু, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, টমেটো, লালশাক, পটোল, বাঁধাকপি, শসা, মটরশুঁটিসহ মোট ৯ ধরনের সবজি সংগ্রহ করেছিল। গবেষণায় এই সবজিগুলোয় লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ বেশ কয়েকটি ভারী ধাতুর উচ্চমাত্রায় উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে লালশাকে। ক্রোমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে শিম, শসা, ঢ্যাঁড়স, পটোল ও লালশাকে। লেডের মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে বেগুন, বাঁধাকপি, শিম, শসা, ঢ্যাঁড়স, পটোল, টমেটো, লালশাকসহ ৯ সবজিতে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে বেগুন, ঢ্যাঁড়স, টমেটো ও লালশাকে। বেগুনে পাওয়া গেছে ২৭৫ দশমিক ৬৬ মাইক্রোগ্রাম ক্যাডমিয়াম, ঢ্যাঁড়সে ৩৪৯ মাইক্রোগ্রাম ও টমেটোতে ১৯৫ মাইক্রোগ্রাম।
গবেষণা বলছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে সংগৃহীত শাকসবজিতে সবচেয়ে বেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর আর্সেনিকযুক্ত শাকসবজি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে শেরপুর জেলায়।
ফলমূলের গবেষণার অংশ হিসেবে গবেষক দল আম, লিচু, বরই ও পেয়ারার ৮০টি করে মোট ৩২০টি নমুনা পরীক্ষা করেছে। ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া থেকে নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। ৩৯টি নমুনায় কীটনাশকের রেসিডিউ (অবশিষ্টাংশ) উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে, ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে লিচুতে। এটিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়। এ ছাড়া আমে পাওয়া গেছে কীটনাশকের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ অবশিষ্টাংশ।
কীটনাশকের মাত্রা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে গবেষক দল কৃষকদের নিয়মিত তদারকির অনুরোধ জানিয়েছে। এ ছাড়া উত্তম কৃষিচর্চার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে তারা।
সার্বিক বিষয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডিন অধ্যাপক বিল্লাল হোসেন বলেন, পোকা দমন ও উৎপাদন বাড়াতে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এসব কীটনাশক ব্যবহার হয়তো বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে এসব শাকসবজি ও ফলমূলে কীটনাশক ব্যবহারের কয় দিন পর তুলতে হবে এবং খাওয়া যাবে, সে বিষয়ে মাঠে তদারকি নেই। এ কারণে এসব খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত পদার্থ পাওয়া যাচ্ছে। এসব পদার্থমিশ্রিত খাবার বেশি দিন খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি, কিডনি রোগ, নার্ভ সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ার মতো মারাত্মক রোগব্যাধি হতে পারে